হাঁটুর ব্যথা - ঘরোয়া এবং আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা
আমরা অনেক বয়স্ক মানুষকে হাঁটুর ব্যথায় ভুগতে দেখেছি। এমনকি, দিনরাত ওষুধ খেয়েও তাদের কোনও আরাম মেলে না, হাঁটাচলা করতে খুব অসুবিধা হয়, হাঁটু মুড়তে বা উঠতে বসতেও অসুবিধে হয়। কখনও তারা এত ব্যথা অনুভব করেন যে তারা সঠিকভাবে ঘুমোতে পারেন না এবং হাঁটু ফুলে যায়। বয়সের সাথে হাড়ের রোগও বাড়তে থাকে।
গাঁটের ব্যথা বা বাত হয় তখন, যখন হাড়ের বিভিন্ন জোড়গুলো ফুলে যায় বা যখন কার্টিলেজ (কোমলাস্থি) শরীরের মধ্যে দ্রবীভূত হয়। দেহের জোড় এমন জায়গা যেখানে দুই বা একাধিক হাড় একে অপরকে সংস্পর্শ করে, যেমন নিতম্বের জোড় বা হাঁটু। কার্টিলেজ জোড়গুলোতে একটি গদির মত স্তর থাকে যা চাপ থেকে তাদের রক্ষা করে এবং যে কোনোরকম নড়াচড়া সহজতর করে তোলে। যখন কোন গাঁটে এই কার্টিলেজ ভেঙ্গে যায়, তখন আপনার হাড়গুলি একে অপরের সাথে ঘষা খায় যার থেকে ব্যথা হয় বা গাঁট ফোলা যায়।
সবচেয়ে প্রচলিত ধরনের বাত হল গাঁটের বাত। এই ধরনের বাত, নির্দিষ্ট কোনও গাঁটের দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহার বা ব্যক্তির বয়সের বৃদ্ধির সাথে সাথে জোড়গুলো ক্ষয়ে যাওয়ার ফলে হয়। অনেক সময়ে দুটো হাড়ের সংযোগস্থলে আঘাত পেলেও বাত হতে পারে। হাড়ের বাত সাধারণত হাঁটু, নিতম্ব এবং হাতে হয়। জোড়গুলোতে ব্যথা হয় এবং ফুলে ওঠে। মাঝে মাঝে জোড়গুলোর পার্শ্ববর্তী তন্তুগুলোতে সংকোচনের কারণেও ব্যথা বাড়ে।
বাত বা আর্থ্রাইটিস কি?
বাত দীর্ঘসময় ধরে ব্যবহৃত কোনও গাঁটে ব্যথা হওয়ার ফলে হয়, যা সাধারণত শরীরের ওজন বহনকারী জোড়গুলো যেমন হাঁটু, নিতম্ব, মেরুদণ্ড ইত্যাদির ওপর প্রভাব ফেলে। এই কারণে জোড়গুলোতে ব্যথা হয়, কঠোর হয়ে যায় এবং তাদের স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপ সীমিত হয়ে পড়ে। সময়ের সাথে সাথে বাতের অবস্থা ধীরে ধীরে আরও খারাপ হতে থাকে। যদি এটার চিকিৎসা না করা হয়, তাহলে হাঁটুর এই বেদনাদায়ক বাত সেই ব্যক্তির জীবনে প্রভাব ফেলতে পারে। বাতের কারণে ভোগা ব্যক্তি তাদের দৈনন্দিন কার্যকলাপ বজায় রাখতে পারবেন না, এমনকি হাঁটাচলার মত সাধারণ কাজগুলিও কঠিন হয়ে উঠবে। এই ক্ষেত্রে, ডাক্তার ক্ষতিগ্রস্ত হাঁটু প্রতিস্থাপন করতে অস্ত্রোপচার পরামর্শ দিতে পারেন।
কেন বাত হয়?
অস্বাস্থ্যকর খাবার, ব্যায়ামের অভাব এবং ওজন বাড়ার কারণে হাঁটুর ব্যথা ভারতের মতো দেশে একটি প্রধান সমস্যার আকার ধারণ করছে। দেখা গেছে, ৪০ থেকে ৪৫ বছর বয়সেই হাঁটুর সমস্যা শুরু হয়ে যায়। সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ হাঁটুর ব্যথায় আক্রান্ত। এর মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ আর্থারাইটিসের মত রোগের সাথে লড়াই করছে। এর মধ্যে ৮০% মানুষ সহজে হাঁটু ঘোরাতেই পারেন না। হাঁটুর সমস্যায় ভোগা ২৫% মানুষ সহজে তাদের দৈনন্দিন কাজও করতে পারেন না। এই সমস্যা ভারতে এই মুহূর্তে খুব গুরুতর। হাঁটুর ব্যথা মূলত ব্যক্তিগত জীবনধারার থেকে হয়। জীবনধারা এবং খাওয়াদাওয়া স্বাস্থ্যকর না হলে, এই সমস্যা আরও গুরুতর হতে পারে। হাঁটু পুরো শরীরের ওজন বহন করে। এমন রোগীদের সারিয়ে তোলার উপায় হল সুস্থ জীবনধারা বজায় রাখা, নিয়মিত ব্যায়াম এবং স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া। সঠিক পরিমাণে ক্যালসিয়াম এবং সবজি খাওয়া; চর্বিযুক্ত খাবার, চিনি, ইত্যাদি না খাওয়া এবং মোটা হয়ে যাওয়া থেকে এড়িয়ে চলা। ওজন কমিয়ে ফেলতে পারলে কি আর্থারাইটিস বা হাঁটুর ব্যথা থেকে নিস্তার পাওয়া যাবে?
হাঁটুর ব্যথায় ভোগা ব্যক্তির জন্য নির্ধারিত ওজনের থেকে বেশি শারীরিক ওজন বা স্থূলতা হাঁটুর জোড়গুলোর পক্ষে ক্ষতিকারক হতে পারে। অতিরিক্ত ওজন থেকে জোড়গুলোতে অতিরিক্ত চাপ পড়ে; মাংসপেশি এবং আশেপাশের প্রসারিত কণ্ডরায় টান পড়ে আর কার্টিলেজ ছিঁড়ে যাওয়ায় দ্রুত পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যায়। এছাড়াও, ধীরে ধীরে ব্যথা বৃদ্ধি পায় এবং এর জন্যে সেই ব্যক্তি সক্রিয় এবং স্বাধীন জীবনযাপন করতে অক্ষম হন।
এটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে যে স্থূল মানুষের মধ্যে ওজন বৃদ্ধির সাথে সাথে বাতের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায় (বিশেষ করে ওজন ভারবহন জোড়গুলোয়)। অতএব, স্থূল ব্যক্তিদের তাদের ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে বা কমাতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
বাতের কারণে কষ্ট পাওয়া স্থূল বা বেশি ওজনের ব্যক্তিদের ১ পাউন্ড (০.৪৫ কেজি) কমলে হাঁটুর ওপরে পড়া ভার ৪ গুণ কমে যায়। সুতরাং, ওজন কমে যাওয়া জোড়গুলোতে ব্যথা কমাতে এবং বাতের ব্যথা বেড়ে যাওয়াকে বিলম্বিত করতে সাহায্য করে। হাঁটুর ব্যথার বিভিন্ন কারণ হতে পারে।
- অতিরিক্ত ওজন
- কোষ্ঠকাঠিন্য
- অস্বাস্থ্যকর বাইরের খাবার খাওয়া
- অতিরিক্ত বাইরের খাবার খাওয়া
- ভাজা জিনিস খাওয়া
- কম পরিমাণে জল খাওয়া
- শরীরে ক্যালসিয়ামের অভাব
হাঁটুর ব্যথা থেকে রক্ষা পাওয়ার কিছু সহজ উপায় (হাঁটুর ব্যথা কমানোর ঘরোয়া পদ্ধতি)
- ১ গ্রাসকে কম করে ৩২ বার চিবোনো। এই সাধারণ পদ্ধতিতে কয়েক দিনের মধ্যেই হাঁটুতে সাইনোবিয়াল ফ্লুয়িড তৈরি হতে থাকে।
- সারা দিনে অন্তত ১২ গ্লাস জল খেতে হবে। খেয়াল করবেন, কম পরিমাণে জল খাওয়া হাঁটুতে ব্যথা বাড়িয়ে তোলে।
- খাবারের সাথে অঙ্কুরিত মেথি গ্রহণ করতে হবে।
- ২৫ গ্রাম অ্যালোভেরার তাজা দানার সাথে ১ থকে ২টি কালো মরিচ এবং একটু কালো লবণ আর জল পান করুন। এটি খালি পেটে খান। যদি হাঁটুতে সাইনোবিয়াল ফ্লুয়িড কমে যায়, তবে এই পদ্ধতি মেনে চললে আবার সাইনোবিয়াল ফ্লুয়িড তৈরি হবে।
- সকালে ৪টি কাঁচা ঢ্যাঁড়শ জলের সাথে খান। সারা দিনে তিনটে আখরোট অবশ্যই খাবেন। এগুলো খেলেও সাইনোবিয়াল ফ্লুয়িড তৈরি হওয়া শুরু করে।
- অ্যাক্যুপ্রেশার রিংটাকে দিনে ৩বার ৩ মিনিটের জন্য অনামিকা আর মধ্যমায় পরে অ্যাক্যুপ্রেশার দিন।
- প্রতিদিন কমপক্ষে ২ থেকে ৩ কিলোমিটার হাঁটুন।
- দিনে দশ মিনিট চোখ বন্ধ করে শুয়ে হাঁটুর ব্যথার খেয়াল রাখুন। নিয়মিত অনুলোম-বিলোম এবং কপাল্ভাতি প্রানায়ানাম করুন। অনুলোম-বিলোম ধীরে ধীরে এবং কম করে ১০০ বার করা অভ্যাস করুন। এতে শীঘ্রই লাভ হয়।
চুন এবং হলুদ একসাথে মিশিয়ে মলম হিসাবে লাগান
- হলুদ এবং চুন ব্যথা অপসারণে উপকারী এবং তা প্রমাণিত।
- হলুদ এবং চুন কিছুক্ষণের জন্য সর্ষের তেলে গরম করে হাঁটুতে লেপে রাখুন।
- কিছু সময় ব্যথা থেকে আরাম পাবেন।
- এই পদ্ধতিটি দিনে দুইবার করবেন।
- হলুদ দুধ: এক গ্লাস দুধের মধ্যে একটি চামচ দিয়ে হলুদ গুঁড়ো মেশান, সকাল বিকেল দু’বার পান করুন। এটি একটি প্রাকৃতিক ব্যথা কমানোর ওষুধ হিসাবে কাজ করে।
প্রাকৃতিক চিকিৎসা:
ভিটামিন-ডি-এর সেরা উৎস সূর্যের রশ্মি যা আপনাকে প্রাকৃতিক ভিটামিন-ডি দেয় যেটা হাড়ের জন্য অনেক উপকারী।
আয়ুর্বেদ অনুযায়ী তৈরি প্রাকৃতিক ঔষধ:
অমৃত সত্ত, গোদন্ত ভস্ম, কোরাল পেস্ট, সোনালি মাক্ষীক ভস্ম, মহাভত বিধ্বংস রস, বৃহৎ বাতচিতমণি রস, একাঙ্গবির রস, মহাযোগরাজ গজ্ঞুল, চন্দ্রপ্রভাবতি, পুনর্নব মণ্ডূর। আয়ুর্বেদিক ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে ওষুধ ব্যবহার করুন। ওষুধ ব্যবহারের সাথে সাথে, আপনি কোনও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ছাড়াই সুবিধা পাবেন।
ব্যথার সময় কখন কি খাবেন না:
আচার খাবেন না, চা পান করার সময়ে হালকা ও সহজপাচ্য খাবার খান ও রাতে হালকা খাবার খান। রাত্রে ছোলা, ঢ্যাঁড়শ, ওল, আলু, কুমড়ো, মুলো, দই, রাজমা ইত্যাদি ভুলেও খাবেন না।